Monday, June 24, 2013

ফেরীঅলা - হেলাল হাফিজ

কষ্ট নেবে কষ্ট
হরেক রকম কষ্ট আছে
কষ্ট নেবে কষ্ট !

লাল কষ্ট নীল কষ্ট  কাঁচা হলুদ রঙের কষ্ট
পাথর চাপা সবুজ ঘাসের সাদা কষ্ট,
আলোর মাঝে কালোর কষ্ট
মালটি-কালারকষ্ট আছে
কষ্ট নেবে কষ্ট ।

ঘরের কষ্ট পরের কষ্ট পাখি এবং পাতার কষ্ট
দাড়ির কষ্ট
চোখের বুকের নখের কষ্ট,
একটি মানুষ খুব নীরবে নষ্ট হবার কষ্ট আছে
কষ্ট নেবে কষ্ট ।

প্রেমের কষ্ট ঘৃণার কষ্ট নদী এবং নারীর কষ্ট
অনাদর ও অবহেলার তুমুল কষ্ট,
ভুল রমণী ভালোবাসার
ভুল নেতাদের জনসভার
হাইড্রোজনে দুইটি জোকার  নষ্ট হবার কষ্ট আছে
কষ্ট নেবে কষ্ট ।
দিনের কষ্ট রাতের কষ্ট
পথের এবং পায়ের কষ্ট
অসাধারণ করুণ চারু কষ্ট ফেরীঅলার কষ্ট
কষ্ট নেবে কষ্ট ।

আর কে দেবে আমি ছাড়া
আসল শোভন কষ্ট,
কার পুড়েছে জন্ম থেকে কপাল এমন
আমার মত কজনের আর
সব হয়েছে নষ্ট,
আর কে দেবে আমার মতো হৃষ্টপুষ্ট কষ্ট।

ঘরোয়া রাজনীতি - হেলাল হাফিজ

ব্যর্থ হয়ে থাকে যদি
প্রণয়ের এতো আয়োজন,
আগামী মিছিলে এসো
স্লোগানে স্লোগানে হবে কথোপকথন।

আকালের এই কালে
সাধ হলে পথে ভালোবেসো,
ধ্রুপদী পিপাসা নিয়ে আসো যদি
লাল শাড়িটা তোমার পড়ে এসো।

মানবানল - হেলাল হাফিজ

আগুন আর কতোটুকু পোড়ে ?
সীমাবদ্ধ ক্ষয় তার সীমিত বিনাশ,
মানুষের মতো আর অতো নয় আগুনের সোনালি সন্ত্রাস।

আগুন পোড়ালে তবু কিছু রাখে
কিছু থাকে,
হোক না তা শ্যামল রঙ ছাই,
মানুষে পোড়ালে আর কিছুই রাখে না
কিচ্ছু থাকে না,
খাঁ খাঁ বিরান, আমার কিছু নাই।

উৎসর্গ – হেলাল হাফিজ

আমার কবিতা আমি দিয়ে যাবো
আপনাকে, তোমাকে ও তোকে।

কবিতা কি কেবল শব্দের মেলা, সংগীতের লীলা?
কবিতা কি ছেলেখেলা, অবহেলা রঙিন বেলুন?
কবিতা কি নোটবই, টু-ইন-ওয়ান, অভিজাত মহিলা -সেলুন?

কবিতা তো অবিকল মানুষের মতো
চোখ-মুখ-মন আছে, সেও বিবেক শাসিত,
তারও আছে বিরহে পুষ্পিত কিছু লাল নীল ক্ষত।

কবিতা তো রূপান্তরিত শিলা, গবেষণাগারে নিয়ে
খুলে দেখো তার সব অণু-পরমাণু জুড়ে
কেবলি জড়িয়ে আছে মানুষের মৌলিক কাহিনী।
মানুষের মতো সেও সভ্যতার চাষাবাদ করে,
সেও চায় শিল্প আর স্লোগানের শৈল্পিক মিলন,
তার তা ভূমিকা চায় যতোটুকু যার উৎপাদন।

কবিতা তো কেঁদে ওঠে মানুষের যে কোনো অ-সুখে,
নষ্ট সময় এলে উঠানে দাঁড়িয়ে বলে,–
পথিক এ পথে নয়
ভালোবাসা এই পথে গেছে

আমার কবিতা আমি দিয়ে যাবো
আপনাকে, তোমাকে ও তোকে।

ইচ্ছে ছিলো - হেলাল হাফিজ

ইচ্ছে ছিলো তোমাকে সম্রাজ্ঞী করে সাম্রাজ্য বাড়াবো
ইচ্ছে ছিলো তোমাকেই সুখের পতাকা করে
শান্তির কপোত করে হৃদয়ে উড়াবো।

ইচ্ছে ছিলো সুনিপূণ মেকআপ-ম্যানের মতো
সূর্যালোকে কেবল সাজাবো তিমিরের সারাবেলা
পৌরুষের প্রেম দিয়ে তোমাকে বাজাবো, আহা তুমুল বাজাবো।

ইচ্ছে ছিলো নদীর বক্ষ থেকে জলে জলে শব্দ তুলে
রাখবো তোমার লাজুক চঞ্চুতে,
জন্মাবধি আমার শীতল চোখ
তাপ নেবে তোমার দুচোখে।

ইচ্ছে ছিল রাজা হবো
তোমাকে সাম্রাজ্ঞী করে সাম্রাজ্য বাড়াবো,
আজ দেখি রাজ্য আছে
রাজা আছে
ইচ্ছে আছে,
শুধু তুমি অন্য ঘরে।

পৃথক পাহাড় – হেলাল হাফিজ

আমি আর কতোটুকু পারি ?

কতোটুকু দিলে বলো মনে হবে দিয়েছি তোমায়,
আপাতত তাই নাও যতোটুকু তোমাকে মানায়।

ওইটুকু নিয়ে তুমি বড় হও,
বড় হতে হতে কিছু নত হও
নত হতে হতে হবে পৃথক পাহাড়,
মাটি ও মানুষ পাবে, পেয়ে যাবে ধ্রুপদী আকাশ।

আমি আর কতোটুকু পারি ?
এর বেশি পারেনি মানুষ।

যুগল জীবনী – হেলাল হাফিজ

আমি ছেড়ে যেতে চাই, কবিতা ছাড়ে না।
বলে,–’কি নাগর
এতো সহজেই যদি চলে যাবে
তবে কেন ঘর বেঁধেছিলে উদ্ধাস্তু ঘর,
কেন করেছিলে চারু বেদনার এতো আয়োজন।
শৈশব কৈশোর থেকে যৌবনের কতো প্রয়োজন
উপেক্ষার ডাস্টবিনেফেলে
মনে আছে সে-ই কবে
চাদরের মতো করে নির্দ্বিধায়
আমাকে জড়ালে,
আমি বাল্য-বিবাহিতা বালিকার মতো
অস্পষ্ট দুচোখ
তুলে নির্নিমেষে তাকিয়েছিলাম
অপরিপক্ক তবু সন্মতি সূচক
মাথা নাড়িয়েছিলাম
অতোশতো না বুঝেই বিশ্বাসের দুই হাত
বাড়িয়েছিলাম,
ছেলেখেলাচ্ছলে
সেই থেকে অনাদরে, এলোমেলো
তোমার কষ্টের সাথে শর্তহীন সখ্য
হয়েছিলো,
তোমার হয়েছে কাজ, আজ প্রয়োজন আমার
ফুরালো’?
আমি ছেড়ে যেতে চাই, কবিতা ছাড়ে না।
দুরারোগ্য ক্যান্সারের মতো
কবিতা আমার কোষে নিরাপদ আশ্রম গড়েছে
সংগোপনে বলেছে,–’হে কবি
দেখো চারদিকে মানুষের মারাত্মক দুঃসময়
এমন দুর্দিনে আমি পরিপুষ্ট প্রেমিক আর
প্রতিবাদী তোমাকেই চাই
কষ্টে-সৃষ্টে আছি
কবিতা সুখেই আছে,–থাক,
এতো দিন-রাত যদি গিয়ে থাকে
যাক তবে জীবনের আরো কিছু যাক।

রাখাল – হেলাল হাফিজ

আমি কোনো পোষা পাখি নাকি?
যেমন শেখাবে বুলি
সেভাবেই ঠোঁট নেড়ে যাবো, অথবা প্রত্যহ
মনোরঞ্জনের গান ব্যাকুল আগ্রহে গেয়ে
অনুগত ভঙ্গিমায় অনুকূলে খেলাবো আকাশ,
আমি কোনো সে রকম পোষা পাখি নাকি?

আমার তেমন কিছু বাণিজ্যিক ঋণ নেই,
কিংবা সজ্ঞানে এ বাগানে নির্মোহ ভ্রমণে
কোনোদিন ভণিতা করিনি। নির্লোভ প্রার্থনা
শর্ত সাপেক্ষে কারো পক্ষপাত কখনো চাবো না।

তিনি, শুধু তিনি
নাড়ীর আত্মীয় এক সংগঠিত আর অসহায় কৃষক আছেন
ভেতরে থাকেন, যখন যেভাবে তিনি আমাকে বলেন
হয়ে যাই শর্তাহীন তেমন রাখাল বিনা বাক্য ব্যয়ে।

কাঙাল কৃষক তিনি, জীবনে প্রথম তাকে যখন বুঝেছি
স্বেচ্ছায় বিবেক আমি তার কাছে শর্তাহীন বন্ধক রেখেছি।

যাতায়াত - হেলাল হাফিজ

কেউ জানে না আমার কেন এমন হলো।
কেন আমার দিন কাটে না রাত কাটে না
রাত কাটে তো ভোর দেখি না
কেন আমার হাতের মাঝে হাত থাকে না কেউ জানেনা।
নষ্ট রাখীর কষ্ট নিয়ে অতোটা পথ একলা এলাম
পেছন থেকে কেউ বলেনি করুণ পথিক
দুপুর রোদে গাছের নিচে একটু বসে জিরিয়ে নিও,
কেই বলেনি ভালো থেকো সুখেই থেকো
যুগল চোখে জলের ভাষায় আসার সময় কেউ বলেনি
মাথার কসম আবার এসো
জন্মাবধি ভেতরে এক রঙিন পাখি কেঁদেই গেলো
শুনলো না কেউ ধ্রুপদী ডাক,
চৈত্রাগুনে জ্বলে গেলো আমার বুকের গেরস্থালি
বললো না কেউ তরুন তাপস এই নে চারু শীতল কলস।
লন্ডভন্ড হয়ে গেলাম তবু এলাম।
ক্যাঙ্গারু তার শাবক নিয়ে যেমন করে বিপদ পেরোয়
আমিও ঠিক তেমনি করে সভ্যতা আর শুভ্রতাকে বুকে নিয়েই
দুঃসময়ে এতোটা পথ একলা এলাম শুশ্রূষাহীন।
কেউ ডাকেনি তবু এলাম, বলতে এলাম ভালোবাসি।